বাশার মাহমুদ (ইংরেজি: Basher Mahmud; ১৯৫২ - ২০২১) ছিলেন একাধারে কবি, কলামিস্ট, গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, সমাজসেবী, সংগঠক, নাট্যকলা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। মাদারিপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেন।
বাল্যকাল ও শিক্ষা
বাশার মাহমুদ ১৯৫২ সালের ১লা মে মাদারিপুর শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। আজীবন পানিছত্র এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেছেন। তাঁর পিতার নাম এনায়েতউল্লাহ এবং মায়ের নাম বেগম হাফিজা। নয় ভাই- বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
তিনি পৌর অফিস সংলগ্ন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাদারিপুর থেকে পঞ্চম শ্রেণি, ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাদারিপুর থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি, সরকারি নাজিমুদ্দিন কলেজ মাদারিপুর থেকে ১৯৭২ সালে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্ম জীবন
নাট্যকলা
ষাটের দশকে প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ছাত্রাবস্থায় তিনি নাটকে অভিনয় শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে নাট্য নির্দেশনা, লেখা, একাধিক কবিতা-গল্প ও কাব্যগ্রন্থের নাট্য রূপান্তর এবং পরিচালনা করেন। যা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হয় এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয় নাজিমুদ্দিন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ছাত্রাবস্থায় ম্যাক্সিম গোর্কীর বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস রূপান্তরিত ও নির্দেশিত মা নাটকে নির্দেশকের প্রধান সহকারি ছাড়াও প্রাণবন্ত অভিনয়ের জন্য দর্শকনন্দিত হন। স্বাধীনতা উত্তরকালে তাঁর প্রচেষ্টায় স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গড়ে ওঠে শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও পরিচালক ছিলেন তিনি। ১৯৭৬ সালে তিনি সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে মাদারিপুর নাট্যগোষ্ঠী নামে রূপান্তরিত করেন। ১৯৮১ সালে সংগঠনটি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্যপদ লাভ করে। মাদারিপুর নাট্যগোষ্ঠী অসংখ্য নাটক মঞ্চায়ন, নাট্যকর্মী তৈরিসহ নাট্য আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের মাধ্যমে মাদারিপুরের নাট্যঙ্গনকে প্রাণবান করে তোলেন। পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ এর গীতি নৃত্য কাব্য নাট্য রূপান্তর ও পরিচালনা করেন, যা কখনও আংশিক কখনও পূর্ণঙ্গরূপে শতাধিকবার সফলভাবে মঞ্চস্থ হয়। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প অবলম্বোনে খোকা বাবুর প্রত্যাবর্তন নাটকটি পরিচালনা ও কেন্দ্রীয় চরিত্র 'রাইচরণের' ভূমিকায় অভিনয় করে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পান। এছাড়া বাশার মাহমুদ নির্দেশিত ও অভিনীত মঞ্চসফল নাটকগুলোর মধ্যে সুবচন নির্বাসনে, এখন দঃসময়, ওরা কদম আলী, চোর চোর, এবার ধরা দাও, ফলাফল নিম্নচাপ, কবর, এখনও ক্রীতদাস, চারদিকে যুদ্ধ, ফাঁস, পোস্ট মাস্টার, নিস্কৃতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির নাট্যঙ্গনের গুরু বাশার মাহমুদ। তখন শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী সংগঠটির সাথে যুক্ত হয়ে বাশার মাহমুদের নির্দেশনায় কল্যাণ মিত্রের ত্রিরত্ন নাটকে 'রত্ন' চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয় জীবনে সর্বপ্রথম দর্শকদের সামনে অভিনয় করেন। এরপর এই সংগঠনের সদস্য হয় টাকা আনা পাই, দায়ী কে, সমাপ্তি, অবিচার সহ ৬টি মঞ্চ নাটকে অংশ নেয়।
সাংবাদিকতা
ঢাকা খেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিপ্লব-এর মহকুমা সংবাদদাতা হিসেবে বাশার মাহমুদের সাংবাদিকতা শুরু। ১৯৭২ সালে দৈনিক স্বদেশ ও ১৯৭৪ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় মহকুমা প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন বিনোদন ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় মাদারিপুরের নিজস্ব সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছন। যে কারণে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই স্থানীয় প্রেসক্লাবের সদস্যপদ লাভ করেন এবং মাদারিপুর মহকুমা প্রেসক্লাব - এর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হলে তিনি যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি মাদারিপুর থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছন। এছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবে প্রচুর প্রশংসা অর্জন করেছেন। পরবর্তীতে আমৃত্যু তিনি দৈনিক সোনালী বার্তা পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি এবং দৈনিক বিশ্লষণ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাহিত্য চর্চা
বাশার মাহমুদ ছোটবেলা থেকেই কবিতা, গল্প, নাটক লেখা-লেখি শুরু করেন এবং আমৃত্যু তা অব্যাহত রেখেছিলেন, যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বহু সংকলন ও স্মরণিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেছেন। তিনি মাদারিপুর মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতিকথা নামক সচিত্র গ্রন্থের নির্বাহী সম্পাদক। কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম (সিপিএফ) এর কার্যক্রম অবলম্বনে বাশার মাহমুদ রচিত পথ নাটক অপরাধমুক্ত সমাজ চাই অসংখ্যবার সফল প্রদর্শিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত হযরত আদম (আ.) থেকে বিশ্বনবী (স.) ও একজন খোকার ছেলেবেলা ইতোমধ্যে পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার আত্মার পত্রালাপ কবি বাশার মাহমুদের জনপ্রিয় একটি কবিতা -
সুপ্রিয় স্বজন,
আমি কেমন আছি কুশল জানতে চেয়েছো
এইমাত্র খবর পেলুম -
এখানে রাজা আছে, রাজ্য আছে
রাজ শাসন -শোষণ নেই
নিয়মনীতি আছে, রাজনীতি নেই
অফুরন্ত দিগন্ত আছে-আছে খোলা মাঠ
তবুও ডাঙগুটি-কানামাছি খেলার যেনো
ফুসরৎ নেই কারো-
এখানে কুমির কুমির ভয় নেই
জু-জু বুড়িও নেই
আছে শুধু অমরত্ব নিয়ে যতো খেলা
আমার সুখ-দুখের বালাই নেই
আছে অনুভব-অনুভূতি ....।
সোহাগী স্বজন-
আমি এইতো বেশ আছি তোমাকে ছেড়ে
কিন্তু তুমি-তুমি কেমন আছো ---!
'ক্ষণকাল না দেখে পাগল তুমি'
আছো শুধু যোজন-যোজন দিগন্তের ওপারে ।
তবুও জানতে ইচ্ছে করে,
তোমাদের ডুব-সাতার দীঘিতে আজও
লাল লাল পদ্ম ফোটে কি-না
তোমার হারিয়ে যাওয়া নাকফুলটি
খুঁজতে খুঁজতে পেয়েছ কি-না
সেই শাপলা পাতায় চিকন সাপটি
তোমাকে বিষাক্ত জিব দেখায় কি-না ....
প্রিয়তমা আমার,
মানুষেরা বড় অদ্ভুত
চোখের আড়াল হলে কে কার কথা
মনে রাখে বলো ...!
সাহিত্য কর্ম
• একজন খোকার ছেলেবেলা
• হযরত আদম (আ.) থেকে বিশ্বনবী (স.)
• শামান্দারের ঘাট (গবেষণালদ্ধ মাদারিপুরের গোড়ার কথা)
• অপরাধমুক্ত সমাজ চাই (নাটক)
• আমি কেমন আছি (কাব্য)
• বাঙলা ভাষার ব্যাকরণ (প্রমিত বাঙলা বানানরীতিসহ)
• সূফী তত্ত্ব : তরীকা সহায়ক
• কবিতা গল্প ও গল্পের মতো ইতিহাস
সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গন
বাল্যকাল থেকেই বাশার মাহমুদ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে ও পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে সমাজ সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। একসময় জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন রংমশাল খেলাঘর আসর এর সংগঠক ও পরিচালক ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আমরা নতুন ও শুভাকাশ ইশারা শিশু কিশোর ও যুবকল্যান সংগঠনের উপদেশক, মাদারিপুর আর্তসেবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অর্থ সম্পাদক, বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ মাদারিপুর জেলা সংসদের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণার্থে বাশার মাহমুদ ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মাদারিপুর মুক-বধির সমিতি, পরবর্তীতে যার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় মাদারিপুর বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী বল্যাণ সংস্থা। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি মাদারিপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির কার্যকরী সদস্য, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি মাদারিপুর জেলা ইউনিটের আজীবন সদস্য, এম এম হাফিজ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি, মাদারিপুর এর আজীবন সদস্য এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুর শাখার উপদেশক ও আবৃত্তি সংগঠন ভাস্বর এর প্রশিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন।
সম্মাননা ও পুরস্কার
সাহিত্য - সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দর্শক পাঠকের প্রচন্ড ভালোবাসা, প্রশংসা, যশ-খ্যাতি তথা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান / সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছেন -
★ নাট্যকলায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদারিপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা ২০১৫ পদক।
★ মননশীল গল্প প্রতিযোগিতায় সুনীল সাহিত্য পুরস্কার ২০১১।
★ নাট্যাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শুভাকাশ ইশারা সম্মাননা পদক ২০১১।
★ ইতিহাস ঐতিহ্য গবেষণায় দক্ষিণ বাংলা লেখক সম্মেলনে গাঙচিল সাহিত্য পদক ২০০৯।
★ আবৃত্তিতে অবদান রাখার জন্য আবৃত্তি ও উপস্থাপনা সংগঠন মাত্রার বিশেষ সম্মাননা পদক ২০০৮।
★ বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগীয় প্রধান কর্তৃক প্রত্যয়নপত্র ১৯৯৫।
ব্যক্তিগত জীবন
বাশার মাহমুদ ১৯৮৫ সালে পারভীন মাহমুদকে বিয়ে করেন। তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের নাম লিখন মাহমুদ, তানিয়া মাহমুদ ও ইউসুফ মাহমুদ।
মৃত্যু
বাশার মাহমুদ ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর রবিবার সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে মাদারিপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাদারিপুরস্থ পৌর কবরস্থানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।